কয়েক মাস আগে নুরু ফোন করল। হাতে গনা যে দু
চারজন মস্কো ফেরত বন্ধু আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখে নুরু তাদের একজন। ওর দেশের
বাড়ি মানিকগঞ্জের বেতিলায়, দেশেই পরিচয়। আমাদের ছিল সুতার ব্যবসা, ওদের তাঁত, তাই
ওর বড় ভাইয়েরা আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাদের পরিচয় অবশ্য ছাত্র ইউনিয়ন, সিপিবি
এসবের মাধ্যমে। ও মস্কো আসে ১৯৮৭ সালে, আমি সেবার ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। আসি একই
বিমানে। ও বারবার বলেছিল ওকে যেন মস্কো রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আমি ১৯৮৬ – ৮৭ টার্মে
অল সোভিয়েত ছাত্র সংগঠনের শিক্ষা ও সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। মানুষের ধারণা এসব
বিশাল এক পদ, অনেক ক্ষমতার আধার। আমার সেটা কখনই মনে হয়নি। বাইরের শহর থেকে কেউ পড়াশুনার
কাজে মস্কো এলে তাকে সময় দেওয়া আর চিঠিপত্র লিখে তাদের খবরাখবর জানা বা বিভিন্ন
জাতীয় দিবসে শুভেচ্ছা জানানোই ছিল মূল কাজ। সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অবশ্য
অনেক সময় দূতাবাস বা এখানকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেতেন ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে কথা
বলতে, তবে এসবে ক্ষমতার চেয়ে দায়িত্বই বেশি ছিল, অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। আমি
জানতাম এদেশে শহর বদলানো কী কঠিন। তাই নুরু বারবার যখন ওকে মস্কো রাখার জন্য আমাকে বলছিল আমার মনে পড়ছিল তখনকার সভাপতি
সুশান্ত দার কথা। তাই আমি ওকে বলছিলাম মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে যেকোন শহরে
যাওয়ার জন্য। আমি জানতাম এভাবে কথা বললে কেউ খুশি হয়না, তারপরেও বলছিলাম কারণ
জানতাম এ ক্ষেত্রে আমাদের কোন হাত নেই। এসব বলতে গেলে অসম্ভব বিশেষ করে আমাদের মত
সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের জন্য যাদের বাবামা বা ভাইবোনেরা পার্টি বা কোন গণ সংগঠনের
কেউকেটা কেউ ছিলেন না। যাহোক, নুরু মস্কোয় থেকে যায়। এখানেই পাওয়ার ইন্সটিটিউট
থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি করে। কিছুদিন ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে দেশে ভাইদের
নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে নিজে ফ্যামিলি নিয়ে ক্যানাডা চলে যায়। প্রথম
দিকের ধকল কাটিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করে, তবে যেটা জানতাম না সেটা হল ও
শিক্ষকতা শুরু করেছে। ও ফোন করে বলেছিল মিলান আসছে একটা কনফারেন্সে, ওখান থেকে মস্কো
আসবে। দেখা করবে আমার সাথে।
জুনের শেষ সপ্তাহে আমি সেন্ট পিটারসবারগ যাই
একটা কনফারেন্সে, ৩০ তারিখ রাতে ট্রেনে মস্কো ফিরছি হঠাৎ টেলিফোনবেজে উঠলো। নুরু
ফোন করেছে। ও মস্কো সেটা জানানোর জন্য। আমার
ক্লাস শেষ, এখন মস্কো আর রেগুলার আসা হয়না, তাই ভাবলাম দুবনা যাওয়ার আগে ওর সাথে
দেখা করে যাই। দেখা হোল বিবলিওতেকা ইমেনি লেনিনায় দুপুর বারোটায়। অনেক বছর পরে। ওর
ইচ্ছে ছিল ক্রেমলিনের ভেতরে যাওয়া, তবে বেশ বড় লাইন দেখে বললাম রেড স্কয়ারে যেতে,
সেখান থেকে হোটেল রাশিয়ার ওখানে জারিয়াদি বলে নতুন যে পার্ক হয়েছে সেখানে। মস্কো
নদীর উপর ঝুলন্ত ব্যালকনি থেকে চারিদিক দেখে গুমে গেলাম। প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে গুমের।
সেখান থেকে নিকলস্কি পেরেউলক, তারপর মানেঝ আর মস্কো হোটেলের মাঝে বিশাল চত্বরে যে
আন্ডারগ্রাউন্ড সুপার মার্কেট সেখানে খেলাম, কত কথাই না হল দুজনের। খুব ভালো লাগলো
শুনে যে শিক্ষকতার পাশাপাশি নুরু রিসার্চ করছে। আমাদের দেশ থেকে প্রচুর সম্ভাবনাময়
ছেলেমেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে রাশিয়ায় পড়াশুনা করেছে। অনেকে অনেক ভাল ভাল চাকরি
করছে, কিন্তু রিসার্চে আছে খুব কম মানুষই। দেশের কথা হোল। সুধীর দাকে নিয়ে কথা
বললাম। আমার বড় ভাই। অংকের শিক্ষক। এলাকার কত ছেলেমেয়ে যে ওঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে।
ওঁর ছাত্ররা আজ সবাই প্রতিষ্ঠিত, প্রায় সবাই ওঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। রাজনীতি
বা দলাদলি না করেও যে দেশের জন্য অনেক কিছু করা যায় সেটা আমি সুধীর দাকে দেখেই
শিখেছি। সেসময় দেশ থেকে রতন আর দিদির কল এল, নুরুও কথা বলল ওদের সাথে।
খাওয়া দাওয়া শেষে আলেক্সান্দ্রভস্কি গার্ডেন
হয়ে ভ্লাদিমির মোনামাখের স্ট্যাচু আর পাশকভ হাউস হয়ে গেলাম দম দ্রুঝবির দিকে।
নুরুর খুব শখ সেটা দেখার। এরপর আরবাতে কিছুক্ষন ঘোরাফেরা। ছাত্র জীবনে আমার একা
থাকতে মন চাইলেই এখানে আসতাম জনারণ্যে হারিয়ে যেতে। হাজার হাজার মানুষের ভিড়,
তোমাকে কেউ চেনে না, তুমি কাউকে চেন না – পালানোর এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কী হতে
পারে। আমার রুমমেট শ্রীকুমারের সাথে অনেকবার রাতেও এসেছি এখানে তরুণদের রক মিউজিক
শুনতে। প্রায়ই সিভিল ড্রেসের কেজিবির লোকেরা আমাদের সরে যেতে বলত আর ওদের ধরে নিয়ে
যেত। সময়টাই ছিল এমন। এরপর গোগোল সরণি হয়ে গেলাম মেট্রো ক্রপতকিনস্কায়ার দিকে।
মাঝে শলোখোভ নৌকায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন, পাশে শান্ত দনে সাতার কাটছে কসাকদের ঘোড়া।
মেট্রোর সামনে রাস্তার ওপারে রক্ষাকর্তা খ্রিষ্টের বিশাল চার্চ বিকেলের রোদে ঝলমল
করছিল। দুবনা ফিরতে হবে। প্ল্যান ছিল আবার দেখা করব নুরুর সাথে। দু জনার ব্যস্ত
জীবনের রেখা এবার আর মেলেনি। বন্ধুরা আসলে আসলেই ভাল লাগে, শুধু পুরনো দিনেই ফেরা
হয় না, নতুন সাজে সজ্জিত মস্কো শহরকে নতুন করে দেখা হয়।
দুবনা, ১৯ জুলাই ২০১৯
|
Comments
Post a Comment